আমি ডেইজী শাহীনূর। ফরিদপুরের মেয়ে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। স্কুল জীবন শুরু মিরপুর থেকে। কলেজ লাইফ শেষ করি ইডেন কলেজ থেকে। কলেজ জীবন চলাকালীন বিয়ে হয়ে যায়। BA ফাইনাল দেয়া সম্ভব হয়নি প্রথম সন্তানের আগমনে। তারপর দীর্ঘ বিরতি।
ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রেশন করে তিনবার পরিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করি বিভিন্ন সমস্যায় সফল হতে পারি নাই। একটা প্রতিজ্ঞা আমি নিজেকে করেছিলাম BA কমপ্লিট না করে দ্বিতীয় সন্তান না নেয়া।
বিয়ের কারনে আমার জীবনের সবচাইতে বড় স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। যা নিয়ে এখনো আমি কষ্ট পাই। প্রতিজ্ঞা পুরনের জন্য ছেলের বয়স যখন সাত বছর তখন পুনরায় লালমাটিয়া কলেজে কলেজে ভর্তি হই রেগুলার স্টুডেন্ট হিসেবে।
নতুন করে যখন পড়াশুনা শুরু করি তখন পরিবার থেকে বাঁধার সম্মুখীন হই। অনেকটা জোর করে পড়াশোনা শুরু করি। সংসার সন্তান পড়ালেখা সাথে ছিল বাড়ির বড় বৌ এর দায়িত্ব। সব সামাল দিয়ে ভালোভাবে BA কমপ্লিট করি। তারপর দ্বিতীয় সন্তান নয় বছর পর। লেখাপড়ার ইতি টানতে হয়েছিল এখানেই। এখনো আমি ছেলেকে বলি ওর ভার্সিটির খরচ যোগান দিয়ে সামর্থ্য থাকলে আবার স্টুডেন্ট লাইফে ফিরে যেতাম।
জীবনের দীর্ঘ সময় আমার পরিচয় ছিল হাউজ ওয়াইফ। অনেকের প্রশ্ন আপনি কি করেন? আমি কিছু করি না হাউজ ওয়াইফ। এটা ছিলো গত আট মাস আগের উত্তর।
আজ আট মাস পর গর্ব করে আমি বলতে পারি আমি একজন নারী উদ্যোক্তা এখন আমার নিজের একটা পরিচয় গড়ে উঠেছে। আমি এখন পিৎজ্জা আপু। এ নামে সবাই আমাকে চিনে।

আমি মনে মনে গর্ব অনুভব করি যে আমি আমার কাজ দিয়ে পরিচিত। আমার হাতের খাবার মিরপুর ছাড়িয়ে ঢাকা শহরের অনেকেরই প্রিয় খাবার। আমার তৈরী পিৎজ্জা, পাস্তা, আচার ও ডেজার্টের রিভিউ দেখলে মন ভরে যায়।আমার পেইজ “Rannghor” এখন পরিচিত উৎকৃষ্টমানের সুস্বাদু পিৎজ্জার জন্য। “Rannghor” মিরপুর ইতিমধ্যে ৫০০ পিৎজ্জা পৌঁছে দিয়েছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায়। বেশির ভাগ কাস্টমার ই এখন রেগুলার কাস্টমার।। Rannghor এর খাবার আস্থা অর্জন করতে পেরেছে এবং অনেকের মনে জায়গা করে নিয়েছে। আলহামদুলিল্লা্হ।
আমার এই পরিচয় তৈরীর পথ প্রসস্ত হয় ‘উই’ গ্রুপে জয়েনের মধ্য দিয়ে। ৫০+ বয়সে এসে নতুন করে কাজ শুরু করা এবং অনেকখানি সফল হওয়া অনেক নারীর জন্য অনুকরনীয় হতে পারে।
আগাগোড়া আমি একজন গৃহিনী।পেন্ডামিক পরিস্থিতিতে পরিবারের প্রয়োজনে কিছু করার চিন্তা ভাবনা থেকে কাজ শুরু করি।কিছুটা আর্থিক অনটনের সম্মুখীন হই। সেই অবস্থা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা হিসেবে হোম মেইড ফুড ডেলিভারির কাজ শুরু করি। যাতে পরিবারের কাজের পাশাপাশি পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করতে পারি। দঃসময়ে পরিবার কে সাহায্য করতে পারি নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারি। এই দুঃসময়ে উই আমাদের পথ দেখায়।
যেহেতু রান্নাটা আমি খুব ভালো পারি তাই রান্না করা খাবার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেই। নতুন কর্ম জীবন শুরু করি। শুরুতে প্রতিবন্ধকতা ছিলো অনেক। স্বামী ও সন্তানের সহযোগিতায় সকল প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে সাহস নিয়ে পরিশ্রম করা শুরু করি। ফল পেতে শুরু করি খুব অল্প সময়ের মধ্যে। আমার হাতের তৈরী খাবার অনেকরই পছন্দের তালিকায় চলে আসে। নিজের প্রতি আস্থা ছিলো সেই আত্মবিশ্বাস সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু ঘরে মৌজুদ আট টি পিৎজ্জা তৈরীর উপকরন দিয়ে। নিজেদের জন্য রাখা আটটি পিৎজ্জা পুজি করে কাজ শুরু করি। প্রথম দিনই আটটি পিৎজ্জা সেল হয়ে যায়।

পরিচিত জন ও বন্ধুদের ভালোবাসায় নিজের হাতের তৈরী খাবার নিয়ে কাজ করার উৎসাহ পেয়ে যাই। শুরু হলো লড়াই ছেলে ও স্বামী কে সাথে নিয়ে নতুন এক পথচলার। আগের দিন পিৎজ্জা বিক্রি পরের দিন সেই টাকায় বাজার। আল্লাহর অশেষ রহমত আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এখন আমি অনেক ব্যস্ত সংসার ও উদ্যোক্তা জীবন নিয়ে। একা হাতে সব সামাল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ‘আমরা নারী আমরা পারি’ এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা নারীরা এগিয়ে যাবো। সংসারে পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অবদান রাখবো। অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ সময়ের দাবী। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে নারীদের ঘরে বসে কতকিছু করা সম্ভব উই আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে। পথ চলতে সাহস দিয়েছে।
২০২০ সাল সারা বিস্বের জন্য আতংকের। মহামারীর এই সময় এমন কোনো পরিবার হয়তো পাওয়া যাবে না যে কোনো প্রিয়জনকে হারায়নি। আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে ভালোবাসার মুখগুলোকে। এত কিছু হারানোর পরও এই সালটি আমার এবং আমার মতো অনেক নারী উদ্যোক্তার জন্য স্মরণীয়। এই মহামারীর সময় বাঁচার তাগিদে নিজের পরিচয় তৈরী করে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছি।
নারী উদ্যোক্তা হিসেবে চেস্টা থাকবে নারী উন্নয়নে অবদান রাখার। নারীদের সাহস যোগানো। নারীদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত রাখা। ইনশাআল্লাহ আমরা নারীরা সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবো আপন শক্তিতে।
এনএইচ২৪/জেএস/২০২১