কুষ্টিয়া করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে রোগী

0
341

কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে করোনা পজিটিভ শত শত রোগী মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। স্বজনদের চোখের সামনে ছটফট করতে করতে বিনা চিকিৎসায় অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। প্রতি ঘণ্টায় কুষ্টিয়া ২০০ শয্যা বিশিষ্ট করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন একজন রোগী। ঈদের ৭ দিনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শুধু করোনা পজিটিভ ১১১ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এক মাসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৩১৪ জনের ও করোনার দ্বিতীয় ধাপে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাধিক করোনা রোগী মারা গেছেন।

প্রিয়জনের লাশ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা। সবার অভিযোগই হাসপাতালে তারা কোনো চিকিৎসা পাননি। হাসপাতালে অক্সিজেনসহ কোনো কিছুর সংকট নেই। তারপরও প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলা-গাফিলতি রয়েছে। অক্সিজেনের মান ও সিলিন্ডারের প্রেসারে গরমিলের তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডার পেতেও দাবি করা হচ্ছে ঘুষ।

স্বজনের অভিযোগ, মৃত্যুর শেষ মুহূর্তেও কোনো চিকিৎসক ও নার্সকে ডেকেও পাচ্ছেন না স্বজনরা। হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও গাফিলতিতে কেউ সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। এছাড়া সময়মতো অক্সিজেন সিলিন্ডার না পেয়েও অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। টাকা না দিলে সেখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার মেলানো কষ্টসাধ্য বলে অভিযোগ অধিকাংশ পরিবারের সদস্যদের। হাসপাতালে গত কয়েকদিনে অক্সিজেন সিলিন্ডার না পেয়ে বেশ কয়েকজন রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া সদর আসনের এমপি মাহবুবউল আলম হানিফের নির্দেশে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।

জানা যায়, কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে আপাতত অক্সিজেন সংকট নেই। তবে অক্সিজেনের মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। নিয়ম অনুযায়ী অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্রেসার (চাপ) দুই হাজারের উপরে থাকার কথা। কিন্তু কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে স্থানীয়ভাবে রিফিল করা অক্সিজেন সিলিন্ডারে সর্বোচ্চ প্রেসার (চাপ) থাকছে ১৩শ থেকে ১৪শ পর্যন্ত। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, স্থানীয়ভাবে রিফিল করা বড় আকারের সিলিন্ডার এক থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি যাচ্ছে না। অথচ যশোর থেকে একই সাইজের সিলিন্ডার রোগীকে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা দেওয়া যাচ্ছে। একই অভিযোগ হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। হাসপাতালে অক্সিজেন ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক আরফুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। আপনি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলেন।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এমএ মোমেন বলেন, একটি একটি করে সিলিন্ডার চেক করে নেওয়ার মতো জনবল আমাদের নেই। হাসপাতালের সিলিন্ডার রিফিল করা প্রতিষ্ঠান মনির অক্সিজেনে প্রতিনিধি পাঠিয়েছি এবং তাদের ডেকে সঠিকভাবে প্রেসার দিয়ে সিলিন্ডার রিফিলের কথা বলেছি। এরপর আমাদের আর কিছু করার নেই। এখানে গোয়েন্দা সংস্থার লোক আছে, আপনারা আছেন সবাইকে একসঙ্গে দেখভাল করতে হবে।

রোগীর স্বজনের অভিযোগ, দেন-দরবার না হলে নার্স, খালা ও ওয়ার্ডবয় কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে অক্সিজেনের জন্য এক থেকে দেড় ঘণ্টা দ্বারে দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।

হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে থাকা এক ছাত্রলীগ নেতা জানান, হাসপাতালে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখেছি এবং অনেক রোগীর কাছ থেকেও অভিযোগ শুনেছি। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের কাছে জিম্মি রোগী ও স্বজনরা। চোখের সামনে মানুষ শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছেন, এসব দেখে সহ্য করতে পারছি না।

১৮ জুলাই করোনা ওয়ারে সেন্ট্রাল অক্সিজেন বেডে ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ৩০ বছর বয়সি নারী মেরিনা খাতুন। সেন্ট্রাল অক্সিজেন বেডের মিটারে সমস্যা দেখা দিলে হঠাৎ অক্সিজেন বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বজনদের চোখের সামনে ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মেরিনা। বারবার কাকুতি-মিনতি করেও সমস্যা সমাধানে এক সেকেন্ডের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ করেন তার ভাই হালিম উদ্দিন। ১৭ জুলাই অক্সিজেন না পেয়ে মারা যান কুষ্টিয়া সদর উপজেলার স্বর্গপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা খাতুন।

হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় চিকিৎসাধীন আনোয়ারা খাতুনের অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী সিলিন্ডার পেতে স্বজনরা দায়িত্বরত নার্স-ওয়ার্ড বয়দের কাছে বারবার আকুতি জানিয়েও সিলিন্ডার পাননি। ঘটনা তদন্তে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এমএ মোমেন, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার সালেক মাসুদ ও সংশ্লিষ্ট করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসকসহ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. এমএ মোমেন বলেন, কোনো রোগীর মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কর্তব্যে অবহেলা কিংবা কারও গাফিলতি পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ হাসপাতালের ১৪৩টি বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সংযোগ, ২৪টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ও ৬৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এছাড়া খাতা-কলমে হাসপাতালে চারটি আইসিইউ বেড দেখানো হলেও এটি পরিচালনায় নেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক-নার্স। এছাড়া হাসপাতালে করোনা রোগী চিকিৎসায় প্রতিদিনের রোস্টারে যেসব চিকিৎসকদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকে তাদের অনেকেই ওয়ার্ডে রাউন্ডে না এসে ফাইল-রেকর্ড দেখেই রোগী চিকিৎসা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর অধিকাংশেরই প্রয়োজন হচ্ছে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন। কিন্তু সব রোগীকে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দেওয়ার সক্ষমতা নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here